ধরা যাক, একটা টেবিলে কোনো একটা কাঠের টুকরো রয়েছে এবং সেই কাঠের টুকরোর ওপর বল প্রয়োগ করে সেখানে ত্বরণ সৃষ্টি করতে চাচ্ছি। ধরা যাক, ১০.০৬ চিত্রে যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেভাবে ভরটির ওপর বাম থেকে ডানে F বল প্রয়োগ করছি, দেখা যাবে কাঠের টুকরোয় টেবিলের সাথে কাঠের টুকরোর ঘর্ষণের কারণে একটা ঘর্ষণ বল f তৈরি হয়েছে এবং সেটি ডান থেকে বাম দিকে কাজ করে প্রয়োগ করা বলটিকে কমিয়ে দিচ্ছে। কাঠের টুকরোর ওপরে যদি খানিকটা ওজন বসিয়ে দিই, দেখা যাবে ঘর্ষণ বল আরো বেড়ে গেছে। ঘর্ষণ বল কীভাবে তৈরি হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারলেই আমরা দেখব এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যদিও আপাতদৃষ্টিতে কাঠ, টেৰিলকে (কিংবা যে দুটো তলদেশের মাঝে ঘর্ষণ হচ্ছে) অনেক মসৃণ মনে হয় কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলে দেখা যাবে (চিত্র ১০.০৭) সব তলদেশেই এবড়োখেবড়ো এবং এই এবড়োখেবড়ো অংশগুলো যখন একে অন্যকে স্পর্শ করে বা খাঁজগুলো একে অন্যের সাথে আটকে যায়, সেটার কারণেই গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং আমরা বলি বিপরীত দিক থেকে ঘর্ষণ বলের জন্ম হয়েছে।
যদি দুটো তলদেশকে আরো চাপ দেওয়া হয় তাহলে এবড়োখেবড়ো অংশ আরো বেশি একে অন্যকে স্পর্শ করবে, একটির খাঁজ অন্যটির আরো গভীর খাঁজে ঢুকে যাবে এবং ঘর্ষণ বল আরো বেড়ে যাবে ।
ঘর্ষণ এর জন্য তাপ সৃষ্টি হয়। সেটা অনেক সময় সমস্যা। যেমন গাড়ির সিলিন্ডারে পিস্টনকে ওঠা-নামা করার সময়ে সেখানে ঘর্ষণের জন্য তাপের সৃষ্টি হয় আর সেই তাপ নিরক্ষণ করার জন্য গাড়ির ইঞ্জিনকে শীতল রাখতে হয়। তাই সেখানে ঘর্ষণ কমানোর জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আমরা সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি যে ঘর্ষণের কারণে তাপশক্তি তৈরি হয়। শীতের দিনে আমরা হাত ঘসে হাত উত্তপ্ত করি। গাড়ির ইঞ্জিন যে গরম হয়ে ওঠে, সেটিও ঘটে ঘর্ষণের কারণে। কাজেই ঘর্ষণের কারণে অপ্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে শক্তির অপচয় হয়। গাড়ি,প্লেন, জাহাজ, সাবমেরিনকে ঘর্ষণ বলকে পরাস্ত করে এগিয়ে যেতে হয়, সেখানেও অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করতে হয়। অভাবে দেখা হলে মনে হতে পারে ঘর্ষণ বুঝি আমাদের জীবনের একটি উপদ্রব ছাড়া আর কিছু নয় ।
আবার আমরা এর মাঝে দেখেছি ঘর্ষণ আছে বলেই আমরা হাঁটতে পারি, রাস্তায় গাড়ি চলতে পারে, কাগজে পেন্সিল কলম দিয়ে লিখতে পারি, দালান গড়ে তুলতে পারি, পারাস্যুট দিয়ে নিরাপদে নিচে নামতে পারি। আমরা এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারি যেখানে ঘর্ষণ না থাকলে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারতাম না।
কাজেই ঘর্ষণকে উপদ্রব মনে করা হলেও আমাদের মেনে নিতে হবে এটি আমাদের জীবনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপদ্রব।
ঘর্ষণকে চারভাগে ভাগ করা যায়। স্থিতি ঘর্ষণ, গতি ঘর্ষণ, আর্বত ঘর্ষণ এবং প্রবাহী ঘর্ষণ:
স্থিতি ঘর্ষণ (Static Friction): দুটি বস্তু একে অন্যের সাপেক্ষে স্থির থাকা অবস্থায় যে ঘর্ষণ বল থাকে, সেটা হচ্ছে স্থিতি ঘর্ষণ। স্থিতি ঘর্ষণের জন্য আমরা হাঁটতে পারি, আমাদের পা কিংবা জুতোর তলা মাটিতে স্থিতি ঘর্ষণে আটকে থাকে এবং পিছলে পড়ে যাই না।
গতি ঘর্ষণ (sliding Friction): একটি বস্তুর সাপেক্ষে অন্য বস্তু যখন চলমান হয়, তখন যে ঘর্ষণ বল তৈরি হয়, সেটি হচ্ছে গতি ঘর্ষণ। সাইকেলের ব্রেক চেপে ধরলে সেটি সাইকেলের চাকাকে চেপে ধরে এবং ঘুরন্ত চাকাকে গতি ঘর্ষণের কারণে থামিয়ে দেয়। পতি ঘর্ষণ ওজনের উপর নির্ভর করে, ওজন যত বেশি হবে, গতি ঘর্ষণ তত বেশি হবে।
আবর্ত ঘর্ষণের (Rolling Friction): একটি তলের উপর যখন অন্য একটি বস্তু পড়িয়ে বা ঘুরতে ঘুরতে চলে, তখন সেটাকে বলে আবর্ত ঘর্ষণ। সবগুলো ঘর্ষণ বলের মধ্যে এটা সবচেয়ে ছোট তাই আমরা সবসময়েই সকল রকম যানবাহনের মাঝে চাকা লাগিয়ে নেই। চাকা লাগানো স্যুটকেস খুব সহজে টেনে নেওয়া যায়- যদি এর চাকা না থাকত তাহলে মেঝের উপর টেলে নিতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হতো।
প্রবাহী ঘর্ষণ (Fluid Friction): যখন কোনো বস্তু তরল বা বায়বীয় পদার্থের (Fluid) ভেতর দিয়ে যায়, তখন সেটি যে ঘর্ষণ বল অনুভব করে, সেটি হচ্ছে প্রবাহী ঘর্ষণ। প্যারাস্যুট নিয়ে যখন কেউ প্লেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন বাতাসের প্রবাহী ঘর্ষণের কারণে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে পারে। (চিত্র ১০.০৮)
প্রবাহী ঘর্ষণ
একক কাজ: একটা কাগজ উপর থেকে ছেড়ে দাও, নিচে পড়তে কতোটুকু সময় লেগেছে অনুমান কর। এবারে কাগজটি দলামোচা করে ছোট একটা বলের মত করে ছেড়ে দাও। এবারে নিচে পড়তে কতো সময় লেগেছে? কেন? |
একক কাজ
স্থিতি ঘর্ষণ এবং গতি ঘর্ষণ
কাজ: কয়েকটা ম্যাচের খালি বাক্স নাও। সেগুলোর ভেতরে মাটি ভরে বাক্সগুলো খানিকটা ভারী করে নাও। এবারে একটা বইয়ের উপর ম্যাচ বাক্সটা রেখে বইটা ঢালু করতে থাকো। স্থিতি ঘর্ষণের কারণে ম্যাচটি পড়িয়ে যাবে না, তবে একটা নির্দিষ্ট কোলে গেলে ম্যাচ বাক্সটা পড়িয়ে পড়তে শুরু করবে। এই অবস্থায় ম্যাচ বাক্সের গতি ঘর্ষণ কার্যকর হতে শুরু করেছে। একটা ম্যাচ বাক্সের উপর আরো একটি বা কয়েকটি ম্যাচ বাক্স রেখে পরীক্ষাটি আবার করো, দেখবে প্রতিবার তুমি একই ফলাফল পাবে। একাধিক ম্যাচবাক্স রেখে তুমি ওজন বাড়িয়ে স্থিতি ঘর্ষণ বাড়িয়ে দিচ্ছ কিন্তু ঢালু করার সময় একই মাত্রায় ঢালের দিকে বলটি বেড়ে যাচ্ছে বলে ফলাফলের পরিবর্তন হচ্ছে না। |
আমরা আগেই বলেছি ঘর্ষণ বল সবসময়েই প্রয়োগ করা বলের বিপরীত দিকে কাজ করে। সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই ঘর্ষণ বল গতিকে কমিয়ে দেয় এবং আমাদের ধারণা হতে পারে আমরা সর্বক্ষেত্রে বুঝি ঘর্ষণ কমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সেটি সত্যি নয়। তোমরা নিশ্চয়ই কখনো না কখনো কাদার মাঝে কোনো গাড়ি বা ট্রাককে আটকে যেতে দেখেছ। তখন গাড়ির চাকা ঘুরলেও ঘর্ষণ কম বলে কাদা থেকে গাড়ি বা ট্রাক উঠে আসতে পারে না। ঢাকা পিছলিয়ে যায়। তখন গাড়ি বা ট্রাকটিকে তুলে আনার জন্য অন্যভাবে চাকা এবং কাদার মধ্যে ঘর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয় ।
আমরা এর মাঝে জেনে গেছি যে আমাদের প্রয়োজনে ঘর্ষণকে কখনো বাড়াতে হয় এবং কখনো কমাতে হয়।
ঘর্ষণ কমানো:
ঘর্ষণ কমানোর জন্য আমরা যেসব কাজ করি সেগুলো হচ্ছে:
১. যে পৃষ্ঠটিতে ঘর্ষণ হয়, সেই পৃষ্ঠটিকে যত সম্ভব মসৃণ করা। মসৃণ পৃষ্ঠে গতি ঘর্ষণ কম।
২. তেল মবিল বা গ্রিজ-জাতীয় পদার্থ হচ্ছে পিচ্ছিলকারী পদার্থ বা লুব্রিকেন্ট। দুটি তলের মাঝখানে এই লুব্রিকেন্ট থাকলে ঘর্ষণ অনেকখানি কমে যায়।
৩. চাকা ব্যবহার করে ঘর্ষণ কমানো যায়। চাকা ব্যবহার করা হলে বড় গতি ঘর্ষণের পরিবর্তে অনেক ছোট আবর্ত ঘর্ষণ দিয়ে কাজ করা যায়। ঘুরন্ত চাকাতে বল বিয়ারিং ব্যবহার করে সরাসরি
ঘর্ষণের বদলে ছোট স্টিলের বলগুলোর আবর্তন ঘর্ষণের সাহায্যে ঘর্ষণ অনেক কমানো সম্ভব।
৪. গাড়ি, বিমান এ ধরনের দ্রুতগামী যানবাহনের ডিজাইন এমনভাবে করা হয়, যেন বাতাস ঘর্ষণ তৈরি না করে স্ট্রিম লাইন করা পৃষ্ঠদেশের উপর দিয়ে যেতে পারে।
৫. যে দুটি পৃষ্ঠদেশে ঘর্ষণ হয়, তারা যদি খুব অল্প জায়গায় একে অন্যকে স্পর্শ করে তাহলে ঘর্ষণ কমানো যায়।
৬. আমরা দেখেছি ঘর্ষণরত দুটি পৃষ্ঠে বল প্রয়োগ করা হলে ঘর্ষণ বেড়ে যায়, কাজেই লম্বভাবে আরোপিত বল কমানো হলে ঘর্ষণ কমানো যায়।
ঘর্ষণ বাড়ানো: ঘর্ষণ কমানোর জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো করা হয়, সেগুলো করা না হলে কিংবা তার বিপরীত কাজগুলো করা হলেই ঘর্ষণ বেড়ে যায়। তাই ঘর্ষণ বাড়ানোর জন্য আমরা যে সব কাজ করি সেগুলো হচ্ছে:
১. যে দুটি তলে ঘর্ষণ হচ্ছে, সেগুলো অমসৃণ বা খসখসে করে তোলা।
২. যে দুটি তলে ঘর্ষণ হয়, সেগুলো আরো জোরে চেপে ধরার ব্যবস্থা করা।
৩. ঘর্ষণরত তল দুটির মাঝে গতিকে থামিয়ে স্থির করে ফেলা, কারণ স্থির ঘর্ষণ গতি ঘর্ষণ থেকে বেশি ।
৪. ঘর্ষণরত তলের মাঝে খাঁজ কাটা বা ঢেউ খেলানো করা। তাহলে এটি তলদেশকে জোরে আঁকড়ে ধরতে পারে। পানি বা তরল থাকলে সেটি খাঁজে ঢুকে গিয়ে পৃষ্ঠদেশের ঘর্ষণ বাড়াতে পারে।
৫. বাতাস বা তরলের ঘনত্ব বাড়ানো ।
৬. বাতাস বা তরলে ঘর্ষণরত পৃষ্ঠদেশ বাড়িয়ে দেওয়া।
৭. চাকা বা বল বিয়ারিং সরিয়ে দেওয়া।